পরিবেশের জন্য ভাবনা দশম শ্রেণি
Table of Contents
Toggle1. বায়ুমন্ডলের গঠন-

Source-https://sciencenotes.org/
I. ট্রপোস্ফিয়ার- বায়ুমন্ডলের সবচেয়ে নীচের স্তর। 78% N2, 21% O2, 0.04% CO2 বর্তমান। রোদ, ঝড়, বৃষ্টি এখানেই হয়। তাই এর আরেক নাম ক্ষুব্ধমন্ডল। এর উচ্চতা 16 কিমি পর্যন্ত হতে পারে। প্রতি 1 কিমি উচ্চতা বৃদ্ধিতে 6.50C করে উষ্ণতা হ্রাস পায় এবং সর্বনিম্ন উষ্ণতা হয় -560C। ট্রপোস্ফিয়ারের শেষ অংশকে ট্রপোপজ বলে।
II. স্ট্রাটোস্ফিয়ার- 16-50 কিমির মধ্যে পড়ে। ঝড়, বৃষ্টি হয় না বলে একে শান্তমণ্ডল বলে। জেট প্লেন এই স্তর দিয়ে চলাচল করে। এখানে উষ্ণতা আবার বৃদ্ধি পেতে থাকে। সর্বোচ্চ উচ্চতায় উষ্ণতা 00C তে পৌছায়। স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের উচ্চতম অংশকে স্ট্রাটোপজ বলে।
ওজোনোস্ফিয়ার- স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের নীচের দিকে 20-30 কিমি এর মধ্যে ওজোন গ্যাস (O3) দিয়ে তৈরি একটি একটি স্তর রয়েছে। যাকে ওজোন মন্ডল (Ozonesphere) বলা হয়। এটি সূর্য থেকে আগত ক্ষতিকারক অতিবেগুনী রশ্মিকে শোষণ করে পৃথিবীর জীবকুলকে রক্ষা করে।
III. মেসোস্ফিয়ার- 50-80 কিমির মধ্যে পড়ে। এর উচ্চতম অংশকে মেসোপজ বলে। এখানে উষ্ণতা -900C তে এসে পৌছায়। এটি বায়ুমন্ডলের সবচেয়ে শীতলতম স্থান।
IV. থার্মোস্ফিয়ার- বায়ুমন্ডলের 80 কিমি থকে 500 কিমি পর্যন্ত এই স্তর। এই স্তর থেকে থকে আকাশ কালো দেখা যায়। উষ্ণতা বৃদ্ধি পেতে পেতে সর্বোচ্চ স্থানে উষ্ণতা 12500C হয়ে যায়। এই স্তরের নীচের দিকে অনেক আয়ন থাকে বলে একে আয়নোস্ফিয়ারও বলা হয়। এখান থেকে রোডিও তরঙ্গ প্রতিফলিত হয়ে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসে বলে দূরের রেডিও শোনা যায়। মেরুজ্যোতি এখানে দেখা যায়। থার্মোস্ফিয়ারের সর্বোচ্চ স্থানে উষ্ণতা আর বৃদ্ধি হয় না বলে একে থার্মোপজ বলে। International Space Station এই স্তরে অবস্থানে করে।
V. এক্সোস্ফিয়ার- 500 কিমি থেকে 750 কিমি পর্যন্ত এই স্তুর। এখানে মূলত H ও He গ্যাস পাওয়া যায়। এই স্তরের উষ্ণতা 16000C পর্যন্ত হতে পারে।
VI. ম্যাগনেটোস্ফিয়ার- 750 কিমি থেকে 1600 কিমি পর্যন্ত এই স্তর। পৃথিবীর চৌম্বক বলরেখা দিয়ে এই স্তর তৈরি। তাই আহিত মহাজাগতিক কণিকা এখানে এসে ধাক্কা খেয়ে শক্তি বিকিরণ করে।
2.পরিচলন স্রোত ও জলবায়ু-(পরিবেশের জন্য ভাবনা দশম শ্রেণি)
রাতের বেলা সমুদ্র এবং স্থলভাগ উভয়েই ঠান্ডা হতে শুরু করে। কিন্তু জলের আপেক্ষিক তাপ বায়ুর তুলনায় বেশি। তাই স্থলভাগ দ্রুত ঠান্ডা হয়। ফলে তুলনামূলকভাবে স্থলের বায়ু ভারী এবং সমুদ্রের বায়ু হালকা হয় এবং ভূপৃষ্ঠে স্থলভাগ থেকে সমুদ্রের দিকে বায়ু প্রবাহিত হয়। একে স্থলবায়ু বলে। অন্যদিকে, দিনের বেলা স্থলভাগ দ্রুত উত্তপ্ত হয়। সেজন্য এখানকার বায়ু সমুদ্রের বায়ুর তুলনায় হালকা হয়। এর ফলে ভূপৃষ্ঠে সমুদ্রের বায়ু স্থলভাগের দিকে প্রবাহিত হয়। একে সমুদ্রবায়ু বলা হয়। এই সমগ্র প্রক্রিয়াটি হল বায়ুর পরিচলন স্রোত। সূর্য রশ্মির প্রভাবেই এই চক্রটি সম্ভব হয়।
3. ওজোন স্তর সৃষ্টি-
স্ট্যাটোস্ফিয়ারে অতিবেগুনি রশ্মি প্রভাবে অক্সিজেন অণু বিঘটিত হয়ে অক্সিজেন পরমাণু সৃষ্টি করে। এই অক্সিজেন পরমাণু একটি অক্সিজেন অণুর সাথে যুক্ত হয়ে ওজোন অণু তৈরি করে।
{O}_{2}\overset{UV}{\rightarrow }2O, O + {O}_{2}\overset{অনুঘটক}{\rightarrow }{O}_{3} + তাপ
4. ওজোন স্তর ধ্বংস-
ওজোন স্তর ধ্বংসের মূল কারণ হলো বায়ু দূষণ ঘটিত নাইট্রোজেনের অক্সাইড (NO, NO2, N2O3 এবং ক্লোরোফ্লুরো কার্বন (CFC)। NO, NO2 মূলত জেট প্লেন থেকে সৃষ্টি হয়। NO অণু ওজোন গ্যাসের সঙ্গে বিক্রিয়া করে নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড ও অক্সিজেন তৈরি করে। বিক্রিয়াটি নিম্নরূপ।
CFC রেফ্রিজারেটর, পারফিউমের ব্যবহৃত হয়। অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে CFC থেকে Cl পরমাণু সৃষ্টি হয় যা O3 অণুর সঙ্গে বিক্রিয়া করে O2 এবং ক্লোরিন মনোক্সাইড (ClO) তৈরি করে। ClO পুনরায় O3 এর সঙ্গে বিক্রিয়া করে সক্রিয় ক্লোরিন পরমাণু ও অক্সিজেন অণু তৈরি করে। এই সক্রিয় Cl পরমাণু পুনরায় ওজোনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে। এইভাবে একটি উত্তেজিত ক্লোরিন পরমাণু লক্ষ লক্ষ ওজোন অণুকে ধ্বংস করতে সক্ষম।
5. স্বাস্থ্য ও পরিবেশের উপর ওজোন স্তর ধ্বংসের ক্ষতিকারক প্রভাব-
I. অতিবেগুনি রশ্মি সরাসরি পৃথিবী পৃষ্ঠে আপতিত হলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে। ফলে বিশ্ব উষ্ণায়নের পরিমাণ বেড়ে যাবে।
II. অতিবেগুনি রশ্মি সরাসরি মানবদেহে পড়লে চামড়ায় স্কিন ক্যান্সারে প্রবণতা বেড়ে যাবে।
III. উদ্ভিদের ক্লোরোফিল নষ্ট হয়ে যাবে এবং সালোকসংশ্লেষের পরিমাণ কমে যাবে।
6. গ্রিনহাউস এফেক্ট ও বিশ্ব উষ্ণায়ন-
অবলোহিত রশ্মির শোষণের ফলে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ঘটনাকে গ্রিনহাউস এফেক্ট বলে।
শীত প্রধান দেশে কাঁচের তৈরি ঘরে সবজি চাষ করা হয়। সূর্যের আলো এই কাঁচ ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করলেও উদ্ভিদ ও মাটি দ্বারা সেই শোষিত হয়ে যখন বিকিরণ ঘটে তখন আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পায়। এই আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য অবলোহিত প্রকৃতির হয় যা কাঁচ ভেদ করে বাইরে যেতে পারে না ফলে ঘরের ভেতর অবস্থিত বায়ু দ্বারা শোষিত হয় এবং ঘরের উষ্ণতা বৃদ্ধি পায়। এই পদ্ধতি অবলম্বন করে শীত প্রধান দেশে কম উষ্ণতাতেও সবজি চাষ করা যায়।
ঠিক একই রকম ঘটনা ঘটায় কার্বনডাই-অক্সাইড, মিথেন, জলীয় বাষ্পের মত কিছু গ্যাস। এরা ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি অবস্থান করে। সূর্য থেকে আপতিত রশ্মি যখন ভূপৃষ্ঠ থেকে অবলোহিত রশ্মি রূপে নির্গত হয় তখন উক্ত গ্যাস গুলি এই অবলোহিত রশ্মিকে শোষণ করে। এর ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি পায় । এই সমগ্র প্রক্রিয়াটিকে গ্রিনহাউস ইফেক্ট বা বিশ্ব উষ্ণায়ন বলে।
গ্রিনহাউস গ্যাসের উদাহরণ হল- কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO2), মিথেন (CH4), CFC, জলীয় বাষ্প (H2O), নাইট্রাস অক্সাইড (N2O), ওজোন (O3) ইত্যাদি।
নাইট্রোজেন (N2), অক্সিজেন (O2) এরা অতি অবলোহিত রশ্মি শোষণ করে না বলে এরা কিন্তু গ্রিনহাউস গ্যাস নয়।
7. গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রভাব-(পরিবেশের জন্য ভাবনা দশম শ্রেণি)
I. মূল প্রভাব হলো এর জন্য পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
II. পাহাড়, পর্বত ও মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়ার ফলে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্থলভাগের পরিমাণ কমে যাচ্ছে।
III. জলবায়ুর পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে এবং ঝড়ের পরিমাণ ও চরমভাবাপন্ন পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে
8. গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাসে কার্যকরী ভূমিকা-
I. জীবাশ্ম জ্বালানি যেমন- পেট্রোল, ডিজেল, কয়লা ইত্যাদির ব্যবহার কমাতে হবে।
II. অচিরাচরিত শক্তি যেমন সৌরশক্তি, বায়ু শক্তি, ভূতাপ শক্তি ইত্যাদির ব্যবহার বাড়াতে হবে।
III. গাছপালা লাগানো এবং বনভূমি সংরক্ষণের দিকে নজর দিতে হবে।
IV. ক্লোরোফ্লুরোকার্বন জাতীয় পদার্থের ব্যবহার কমাতে হবে।
9.শক্তির যথাযথ ব্যবহার
স্থিতিশীল উন্নয়নে শক্তির ব্যবহার- একটি দেশে তথা পৃথিবীতে স্থিতিশীল উন্নয়ন তখনই সম্ভব আমরা শক্তির ব্যবহার নিয়ন্ত্রিতভাবে করব। এর সঙ্গে এটাও খেয়াল রাখতে লাগবে যে ভবিষ্যতের জন্য যেন আমরা একটি স্বাস্থ্যকর পৃথিবী রেখে যেতে পারি। তাই সেইসব শক্তির দিকে আমাদের নজর দিতে হবে যা তুলনামূলকভাবে পরিবেশবান্ধব।
10. তাপন মূল্য-
একক ভরের বা আয়তনের কোনো জ্বালানিকে পূর্ণ দহনে যে পরিমাণ তাপশক্তি তৈরি হয় তাকে ওই জ্বালানির তাপন মূল্য বলে। এর একক অনেক ধরনের হয় ক্যালোরি/ গ্রাম, জুল/কেজি, কিলো জুল/কেজি, জুল/ঘনমিটার।
বিভিন্ন জ্বালানির তাপন মূল্য
জ্বালানি | তাপুনমূল্য(kJ/kg) | জ্বালানি | তাপুনমূল্য(kJ/kg) |
অ্যানথ্রাসাইট | 34000 | LPG | 50000 |
পেট্রোল | 48000 | প্রাকৃতিক গ্যাস | 40000 |
ডিজেল | 44800 | হাইড্রোজেন | 150000 |
11. বিকল্প জ্বালানি-
কয়লা ডিজেল পেট্রোল এইসব জ্বালানি ধীরে ধীরে কমে আসছে। তাই আমাদের কিছু অপ্রচলিত জ্বালানের দিকে নজর দিতে হবে। কিছু উদাহরণ হল
I. সৌরশক্তি- সিলিকন দ্বারা নির্মিত সোলার প্যানেলে সূর্য থেকে আপতিত আলোক শক্তি তড়িৎ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। কি কাজে লাগিয়ে বিদ্যুতের চাহিদা অনেকটাই পূরণ করা সম্ভব।
II. বায়ুশক্তি- বায়ু প্রবাহের গতিশক্তিকে টারবাইনের সাহায্যে তড়িতশক্তিতে রূপান্তরিত করা যায়। ভবিষ্যতের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাবে।
III. ভূতাপ শক্তি- ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি যেখানে ম্যাগমা অবস্থান করে সেখানে উষ্ণতা 100 ডিগ্রী সেলসিয়াসের কাছাকাছি হতে পারে। একে কাজে লাগিয়ে জলকে গরম করে বাষ্পে পরিণত করা হয়। যার দ্বারা টারবাইনকে ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ শক্তি তৈরি করা সম্ভব।
IV. জোয়ার ভাটা শক্তি- নদীর মোহনায় বা সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় জোয়ার ভাটার জন্য নির্দিষ্ট সময় অন্তর জলের স্রোত বেড়ে যায়। এই স্রোতকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি সম্ভব।
V. জীবভর শক্তি- নির্দিষ্ট অঞ্চলে জীবের মোট ভর কে জীবভর বলে। জীবের মধ্যে সৌরশক্তি রাসায়নিক শক্তি রূপে সঞ্চিত থাকে। এর উদাহরণ হল-কাঠ গাছের ডাল শুকনো পাতা আবর্জনা গোবর ইত্যাদি। এদের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
VI.বায়োগ্যাস- সূর্যের আলোর অনুপস্থিতিতে জৈব বস্তু থেকে নির্গত পদার্থ যেমন- পশু পাখির মল, মূত্র কিংবা উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত পদার্থ যেমন- শাক সবজির খোসা, কচুরিপানা,’ পাতা ইত্যাদি কে নির্দিষ্ট স্থানে রেখে দিলে মিথানোজেনিক ব্যাকটেরিয়ার দ্বারা এদের থেকে মিথেন গ্যাস তৈরি হয়। যাকে বায়োগ্যাস বলা হয়। একে কাজে লাগিয়ে গৃহস্থলীর বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানো যায়।
VII. বায়ো ফুয়েল- জৈব পদার্থ থেকে নির্গত তরল জ্বালানি যেমন মিথানল ইথানল ভবিষ্যতে বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করার প্রচেষ্টা চলছে। বর্তমানে পেট্রোলের সঙ্গে নির্দিষ্ট (10%) পরিমাণ ইথানল মিশিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। একে পাওয়ার অ্যালকোহল বলা হয়।
V. মিথেন হাইড্রেট- সমুদ্রের তলদেশে পৃথিবীপৃষ্ঠের পলিস্তরে প্রচন্ড চাপে মিথেন এবং জল কেলাস রূপে অবস্থান করে। একে মিথেন হাইট্রেট (CH4, 23H2O) বলা হয়। মিথেন হাইড্রেটকে যখন সাধারণ অবস্থায় আনা হয় তখন বরফের মতো দেখতে কেলাসটি ভেঙ্গে যায় এবং মিথেন গ্যাস তৈরি করে। এর জন্য কিছুটা তাপ শক্তি উৎপন্ন হয়। আবার মিথেনকে পুড়িয়েও তাপ শক্তি। যদি মিথেন হাইড্রেটকে জ্বালানো হিসেবে ব্যবহার করা যায় তাহলে ভবিষ্যতের জ্বালানির সংকট অনেকটাই কমে যাবে।
পরিবেশের জন্য ভাবনা দশম শ্রেণি